বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়/Bankim Chandra chattopadhyay
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের এক অমর পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং ভারতীয় উপন্যাস সাহিত্যের পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ২৬ জুন ১৮৩৮ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা) ২৪ পরগনা জেলার কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা এবং মা দুর্গাদেবী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা। তাঁর বাবা শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনা ছিলেন, যা বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন, বিশেষ করে সংস্কৃত এবং বাংলা সাহিত্যের ওপর ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ।
### শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন
বঙ্কিমচন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হুগলি স্কুলে, যেখানে তিনি পড়াশোনা করার সময়ই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৫৮ সালে বিএ পাশ করেন। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ব্যাচের স্নাতক। এরপর তিনি আইনের প্রতি আগ্রহী হন এবং আইন শিক্ষায় শিক্ষিত হন। তবে সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে তাঁর মনোযোগ ছিল আরও গভীর। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং দীর্ঘকাল এই পদে কর্মরত ছিলেন।
### সাহিত্য জীবনের শুরু
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনের শুরুতে তিনি কবিতা লিখতে আগ্রহী ছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে তিনি গদ্য সাহিত্যের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস, **দুর্গেশনন্দিনী** (১৮৬৫) বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত হয়। এতে রোমান্টিকতা, অ্যাডভেঞ্চার, এবং দেশপ্রেমের এক চমৎকার মিশ্রণ ছিল, যা সেই সময়ের পাঠকদের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলে। দুর্গেশনন্দিনীর পরে **কপালকুণ্ডলা** (১৮৬৬) প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী উপন্যাসের স্থান লাভ করে।
### সাহিত্য কর্ম এবং ভাবধারা
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বহুপ্রজ লেখক। তিনি সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলোতে ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট উঠে আসে, যা তৎকালীন ভারতীয় সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিল। তাঁর রচিত গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলির মধ্যে **আনন্দমঠ** (১৮৮২), **বিষবৃক্ষ** (১৮৭৩), **রাজসিংহ** (১৮৮২) উল্লেখযোগ্য। আনন্দমঠ উপন্যাসে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী বার্তা দেন। এই উপন্যাসে তিনি "বন্দে মাতরম" গানটি সন্নিবেশিত করেন, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপুল প্রভাব ফেলে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকর্মে ধর্মীয় এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। তিনি বহু জায়গায় হিন্দু দর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর লেখায় দেশপ্রেম, ন্যায়, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়গুলিও উঠে আসে। তিনি একটি জাতির রূপান্তরিত চিত্রায়ণে ভূমিকা রেখেছেন এবং তাঁর লেখায় তিনি তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার এবং অন্যায়ের বিরোধিতা করেছেন।
### "বন্দে মাতরম" এবং দেশপ্রেম
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিশেষ অবদান তাঁর "বন্দে মাতরম" রচনা। এই গানটি আনন্দমঠ উপন্যাসে স্থান পায়, যেখানে স্বাধীনতার জন্য দেশপ্রেমিকদের ত্যাগ এবং সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়। বন্দে মাতরম গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আজও তা ভারতীয় জাতীয় সংগীতের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রয়েছে। এই গানের মাধ্যমে তিনি মাতৃভূমির প্রতি যে অনুরাগ এবং ভক্তির প্রকাশ ঘটান, তা ভারতীয়দের অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। এই গানের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র একাধারে স্বাধীনতার স্লোগান এবং প্রেরণা রচনা করেন।
### প্রবন্ধ ও সমালোচনামূলক রচনা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু উপন্যাস লেখক ছিলেন না; তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং সমালোচনামূলক রচনাও রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলিতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। **কৃষ্ণচরিত্র** গ্রন্থে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও কার্যাবলী বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর অন্যান্য সমালোচনামূলক গ্রন্থগুলিও পাঠক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সমাজের অন্যায় এবং অনাচারের বিরোধিতা করে তিনি জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
### ব্যক্তিজীবন ও মৃত্যু
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবন বেশ শান্ত ও সুশৃঙ্খল ছিল। তিনি দুইবার বিবাহ করেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী অল্প বয়সে মারা যান এবং পরে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। তবে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বিশেষ তথ্য জানা যায় না, কারণ তিনি নিজেকে বেশিরভাগ সময়ই সাহিত্যকর্মে এবং সরকারি কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন।
১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল মাত্র ৫৫ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যজগতে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে পূরণ করা যায়নি। তবে তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
### বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরাধিকার
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি যে সাহিত্যসম্ভার রেখে গেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের এক মহান ঐতিহ্য এবং বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ। তাঁর লেখনী শক্তির মাধ্যমে তিনি ভারতীয় সমাজে এক গভীর পরিবর্তন আনতে সমর্থ হন। তাঁর দেশপ্রেম, সাহিত্যসৃষ্টি, এবং সমাজ সংস্কারের প্রতি নিবেদিত জীবন তাঁকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে।
তাঁর সাহিত্য শুধু সাহিত্যিক মূল্যেই নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য আজও বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এবং তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।