Biography of Rabindranath Tagore || রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী

Biography of Rabindranath Tagore/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জীবনী 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি কেবল কবি নন, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী এবং সমাজসংস্কারক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 

 **প্রারম্ভিক জীবন**  
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম সমাজ নেতা এবং মা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন স্নেহময়ী গৃহিণী। ঠাকুর পরিবার শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর ও সংস্কৃতিমনা ছিল। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ একটি সৃজনশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত এবং তা খুব একটা সুখকর ছিল না। তবে বাড়িতেই শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তিনি সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং দর্শনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।  

**সাহিত্যজীবনের সূচনা**  
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের সূচনা ঘটে অল্প বয়সেই। আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা রচনা করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর লেখা "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর ধাঁচে কবিতা লিখেছিলেন, যা পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। 

১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে শিক্ষার জন্য পাঠানো হলেও তিনি আইন পড়ার পরিবর্তে সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। বিদেশে থাকাকালীন তিনি ইউরোপীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন, যা তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিতে গভীর প্রভাব ফেলে।  
**সাহিত্যকর্ম ও বৈচিত্র্য**  
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুপ্রজ লেখক। তিনি প্রায় ২,০০০ গান, অসংখ্য কবিতা, ৮টি উপন্যাস, শতাধিক ছোটগল্প এবং বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে:  

- **গোরা**: সমাজ ও ধর্মের দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখা।  
- **চোখের বালি**: নারীর মনস্তত্ত্বের গভীর বিশ্লেষণ।  
- **ঘরে বাইরে**: স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এক জটিল সম্পর্কের গল্প।  

তাঁর কবিতাগুলোর মধ্যে "সোনার তরী", "চিত্রা", "গীতাঞ্জলি" ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯১০ সালে প্রকাশিত **"গীতাঞ্জলি"** তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এর ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর গানগুলোর মধ্যে "আমার সোনার বাংলা" এবং "জনগণমন" যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্থান পেয়েছে।  

**শিক্ষা ও শান্তিনিকেতন**  
শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে "শান্তিনিকেতন" নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি প্রকৃতির সাথে মিল রেখে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন। পরে এটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়, যা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেছে।  

**সমাজসংস্কার ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি**  
রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যিক নন, একজন সমাজসংস্কারকও ছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নারীর স্বাধীনতা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া "নাইটহুড" উপাধি ত্যাগ করেন।  

**চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ**  
জীবনের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর আঁকা ছবিগুলো আধুনিক শিল্পকলার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যবান। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি "রবীন্দ্রসঙ্গীত" নামে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেন, যা আজও জনপ্রিয়।  

**মৃত্যু ও উত্তরাধিকার**  
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।  

আজও তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত ও দর্শন বিশ্বের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তিনি এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, যা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।  
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url