পলাশী যুদ্ধ 1757 || Palaishi War 1757

পলাশী যুদ্ধ 1757 || Palaishi War 1757

Palaishi War 1757

 

পলাশী যুদ্ধ 1957(Palaishi War 1757): বাংলার ইতিহাসে এক বাঁকবদল

পলাশী যুদ্ধ ১৭৫৭,Palaishi War 1757, : সালের ২৩ জুন, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই যুদ্ধের ফলাফল ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি তৈরি করে। সিরাজউদ্দৌলা ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধ বাংলার স্বাধীনতার পতন এবং উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।


যুদ্ধের পটভূমি

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। তরুণ ও সাহসী সিরাজ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান শক্তি ও তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কোম্পানি তার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার নামে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছিল এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল।
সিরাজ কোম্পানির এই কার্যকলাপকে হুমকি হিসেবে দেখেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। কোম্পানির কলকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়াম দখল করেন, যা ব্রিটিশদের কাছে অপমানজনক ছিল। কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্র শুরু করে।

ব্রিটিশরা বাংলার অভ্যন্তরে অসন্তুষ্ট আমলাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে। মীর জাফর, যিনি সিরাজের সেনাপতি ছিলেন, রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠ এবং ওমিচাঁদসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ঘুষ ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তাদের পক্ষভুক্ত করে। এভাবে নবাবের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।


যুদ্ধের ঘটনা

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীতে প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য, ৫০টি কামান এবং অগণিত ঘোড়া থাকলেও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে এই শক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
ব্রিটিশ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির মাত্র ৩,০০০ সৈন্য ও সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। মীর জাফর ও তার অনুগতদের ষড়যন্ত্রের ফলে নবাবের সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।
যুদ্ধের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল। সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী বিপর্যস্ত হয় এবং তিনি পালিয়ে যান। পরে তাকে ধরা হয় এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।


Palaishi War 1757 photo

পলাশী যুদ্ধের পরিণতি

পলাশী যুদ্ধ (১৭৫৭) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধুমাত্র বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় নয়, বরং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনা। যুদ্ধের পরিণতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব পড়েছিল।


১. রাজনৈতিক পরিণতি

ক. নবাবের পতন এবং মীর জাফরের ক্ষমতায়ন:
যুদ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হন। ব্রিটিশরা মীর জাফরকে বাংলার নবাব হিসেবে স্থাপন করে। তবে তিনি কার্যত ব্রিটিশদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। নবাবের ক্ষমতা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক, আর প্রকৃত শাসনভার ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।
খ. ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা:
পলাশী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার প্রশাসনিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেয়। এটি তাদের জন্য পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।
গ. স্থানীয় শাসনের অবসান:
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ক্রমশ পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।


২. অর্থনৈতিক পরিণতি

ক. সম্পদ লুণ্ঠন:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন শুরু করে। মীর জাফরের কাছ থেকে কোম্পানি বিশাল অঙ্কের অর্থ আদায় করে। কোম্পানির কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়। বাংলার অর্থনীতি ক্রমে দুর্বল হতে শুরু করে।

খ. কৃষি ও শিল্পের ধ্বংস:
কোম্পানির নীতির কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্প ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্রিটিশ পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পেরে স্থানীয় শিল্পীরা দারিদ্র্যের শিকার হন।

গ. কর ব্যবস্থার অপব্যবহার:
ব্রিটিশরা কৃষকদের উপর চরম কর আরোপ করে। এর ফলে কৃষকরা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।


৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

ক. সামাজিক অবক্ষয়:
পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার সমাজে দুর্নীতি ও অবিচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। মীর জাফরের মতো বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমতায়নে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা কমে যায়।

খ. দারিদ্র্যের বিস্তার:
অর্থনৈতিক শোষণ এবং সম্পদ লুণ্ঠনের ফলে বাংলার জনগণের জীবনযাত্রার মান নেমে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের প্রভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠে।


৪. ইতিহাসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

ক. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি:
পলাশী যুদ্ধ ছিল ব্রিটিশ শাসনের সূচনা। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে।
খ. স্বাধীনতার অবসান:
বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, যা ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী কয়েকশ বছরের দাসত্বের দিকে নিয়ে যায়।
গ. শিক্ষা ও মনোভাব পরিবর্তন:
এই যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জাতীয় ঐক্য এবং সততার গুরুত্ব বুঝতে পারে।


 ঐতিহাসিক গুরুত্ব

পলাশী যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনাপর্ব। এই যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার দখল নেয়।
বাংলার রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ এই যুদ্ধে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং অসৎ নেতৃত্ব একটি জাতিকে ধ্বংস করতে পারে।


Nawab Sirajuddaula photo

সমাপ্তি

পলাশী যুদ্ধ বাংলার স্বাধীনতার পতনের সূচনা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের প্রথম ধাপ। এটি শুধুমাত্র সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় নয়, বরং একটি জাতির স্বাধীনতার অবসানের প্রতীক। এই যুদ্ধ আমাদের ঐক্য, সততা এবং জাতীয় স্বার্থে কাজ করার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।
অতীতের এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনে সচেষ্ট হওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

------------------------------------------------------------------------------------------------------- 

 Biography of Chhatrapati Shivaji || ছত্রপতি শিবাজী 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url