ন্যাশনাল হিরো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু /National Hero Netaji Subhash Chandra Bose
ন্যাশনাল হিরো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫?) ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক এবং বীরত্বের প্রতীক। তিনি নিজের অসীম সাহস ও সংগ্রামস্পৃহা দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল ত্যাগ, দেশপ্রেম এবং সাহসিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশার কটক শহরে। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী এবং সমাজসেবক, এবং মাতা প্রভাবতী দেবী ছিলেন এক আদর্শ গৃহিণী। সুভাষ ছিলেন পরিবারের নবম সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং কটকের রেভেনশ স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৩ সালে সুভাষ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং দর্শনে স্নাতক হন। তিনি তার শিক্ষাজীবনে সবসময়ই শীর্ষে থাকতেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডে যান।
সুভাষ লন্ডনে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পরও তিনি ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা অনুভব করেন এবং ১৯২১ সালে চাকরি ছেড়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবেশ
ভারতে ফিরে এসে সুভাষচন্দ্র যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেসে। মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সান্নিধ্যে আসেন। যদিও তিনি গান্ধীজির আদর্শে প্রভাবিত হন, তবু তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পার্থক্য ছিল। গান্ধীজির অহিংস নীতি এবং ধৈর্যের নীতির বিপরীতে সুভাষ বিশ্বাস করতেন যে ভারতকে স্বাধীন করতে সরাসরি সংগ্রাম এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রয়োজন।
১৯২৩ সালে সুভাষ কংগ্রেসের অধীনে অল ইন্ডিয়া যুব কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে যুব আন্দোলন শক্তিশালী হয়। সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বহুবার কারাবন্দী করে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল বরাবরই ভারতকে স্বায়ত্তশাসিত করার লক্ষ্যে সরাসরি সংগ্রাম এবং শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা।
ফরোয়ার্ড ব্লক এবং কংগ্রেসের বিভক্তি
সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস আন্দোলনে এক নতুন গতি পায়। তিনি কংগ্রেসের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে ভারতকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরের বছর পুনরায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধী এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্যের কারণে ত্যাগ করেন।
সুভাষচন্দ্র নিজের দল **ফরোয়ার্ড ব্লক** গঠন করেন, যা ছিল তাঁর মূল আদর্শ অনুসারে একটি স্বাধীন দল। তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকের মাধ্যমে এক শক্তিশালী এবং সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষ করে ব্রিটিশবিরোধী শক্তির।
আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ পুলিশের নজর এড়িয়ে জার্মানি পৌঁছান এবং সেখানে হিটলারের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শক্তি তৈরি করা। পরে তিনি **জাপানে** চলে যান, যেখানে তাঁর ঐতিহাসিক **আজাদ হিন্দ ফৌজ** (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ) গঠন করা হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের মূলমন্ত্র ছিল "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।" এই কথাটি ভারতের জনগণের মধ্যে প্রবল উদ্দীপনা জাগায় এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে সক্রিয় করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ করে।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে সুভাষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বর্মা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ চালান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা ইম্ফল এবং কহিমায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়।
নেতাজির মৃত্যুর রহস্য
১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, একটি জাপানি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁকে মৃত্যু বলে ঘোষণা করা হয়। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে, কারণ অনেকেই মনে করেন তিনি বেঁচে ছিলেন এবং পরে ভারতে গোপনে ফিরে আসেন। আজও অনেক ভারতীয়ের কাছে নেতাজির মৃত্যু একটি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।
সুভাষচন্দ্র বসুর উত্তরাধিকার এবং প্রভাব
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। তাঁর বীরত্ব, ত্যাগ, এবং দেশপ্রেম আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের মনে শক্তি ও সাহসের প্রতীক হিসেবে বিরাজমান। তিনি শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন জাতীয় বীর। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রমাণ করেছিল যে ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে কোনও দ্বিধা নেই।
সুভাষচন্দ্র বসুর দেশপ্রেমিক আদর্শ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাঁর সাহসী সংগ্রাম, কর্তব্যপরায়ণতা এবং তাঁর অটল বিশ্বাস ছিল ভারতকে স্বাধীন করার প্রধান চালিকা শক্তি। ভারতীয় যুবসমাজে নেতাজির আদর্শ, তাঁর "বন্দে মাতরম" এবং "জয় হিন্দ" ধ্বনি আজও অনুপ্রেরণা দেয়।
উপসংহার
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর সংগ্রামের দ্বারা প্রমাণিত যে স্বাধীনতার জন্য মানুষ কতটা আত্মত্যাগ করতে পারে। তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।